শিরোনাম |
মামলা হতে নির্দোষদের অব্যাহতির দাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশের।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:
|
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেন দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের ঘটনায় নির্দোষদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার চবি ছাত্রলীগের একাংশ। তাদের দাবি শীঘ্রই নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে শাটল ট্রেন দূর্ঘটনা কে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে উপাচার্যের বাসভবন ও পরিবহন দপ্তরে ভাংচুরের মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর সেই মামলায় ১৪ জন শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করে চবি প্রশাসন। চবি ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, নাম উল্লেখ করা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন শাখা ছাত্রলীগের শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক উপগ্রুপ ‘সিক্সটি নাইন’, ‘সিএফসি’ ও ‘বিজয়’ এর রাজনীতিতে যুক্ত বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত । এর মধ্যে সিক্সটি নাইন গ্রুপের কর্মীরা সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী এবং সিএফসি ও বিজয় গ্রুপের কর্মীরা শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ মো. আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে সাতজনকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন। এ মামলার সাত অভিযুক্ত হলেন পালি বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আমিনুল ইসলাম,শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. রিয়াদ হাসান রাব্বি, ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সৌরভ ভূঁইয়া, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-২০১৬ শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম,ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শাকিল হোসেন আইমুন, সংস্কৃত বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র দীপন বণিক দীপ্ত, ইংরেজি বিভাগের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নুর মোহাম্মদ মান্না। অপরদিকে পরিবহন দপ্তরে ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ বাদী হয়ে সাতজনকে অভিযুক্ত করে আরেকটি মামলা করেন। এ মামলার সাত অভিযুক্ত হলেন দর্শন বিভাগের ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আনিছুর রহমান, ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের ছাত্র নাসির উদ্দিন মো. সিফাত উল্লাহ, বাংলা বিভাগ ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র অনিরুদ্ধ বিশ্বাস, সংস্কৃত বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র অনিক দাশ, বাংলা বিভাগ ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. আজিমুজ্জামান, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. ইমরান নাজির ইমন। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের পেশ করা ১১ দফা দাবির পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে মানববন্ধন। চবি ছাত্রলীগের ১১ দফা সমূহ হলো: ১। শাটল দুর্ঘটনায় আহত সকল শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করতে হব। ২। অনতিবিলম্বে নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের ভিত্তিহীন মামলা হতে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে। ৩। সুষ্ঠু ও সঠিক তন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪। ৭ তারিখ শাটল দুর্ঘটনার গাফিলতি বা অব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু তদন্ত কমিটি গঠন ও জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। ৫। শাটলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও শিডিউল বৃদ্ধি করতে হবে। ৬। ক্যাম্পাসে এবং শাটলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। ৭। অতি দ্রুত রেললাইন সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে রুপান্তর করতে হবে। ৮। দিনের বেলায় ফ্যান চালানো ও পর্যাপ্ত আলোর মাধ্যমে রাতের শাটলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রত্যেক শাটলে পাওয়ার কার নিশ্চিত করতে হবে। ৯। শাটলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য চেইন টেনে শাটল বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। ১০। শাটলে এবং প্রত্যেক স্টেশনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রাখতে হবে। ১১। স্টেশন সংলগ্ন শৌচাগার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গত ৯ অক্টোবর চবি ছাত্র-ছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা কেন্দ্রে এ ঘটনা তদন্ত করে ভাঙচুরের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার প্রেক্ষাপট এবং দোষীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের লিখিত ও মৌখিক মতামত গ্রহণ করে। এ সময় অনেক শিক্ষার্থীরাই অভিযুক্তদের উক্ত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা নেই বলে মত দিয়েছে। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে দীপন বণিক দীপ্ত বলেন, আমি বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর রোধ করতে সাহায্য করেছি। ঘটনার দিন আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছি। আমার জীবন আর আগের মত নেই, মানসিক অশান্তি ও ডিপ্রেশনে ভুগছি। পারিবারিকভাবে প্রচুর হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছি। এমন ভাংচুর ও সহিংসতা কোন মতেই আমাদের কাম্য নয়। যারা প্রকৃত দোষী তাদের শাস্তি হোক এবং যারা আমাদের মত নির্দোষ তাদের সসম্মানে মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। অভিযুক্ত মো. আজিমুজ্জামান বলেন, আমি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কোনভাবেই এর সাথে জড়িত ছিলাম না। ঘটনার দিন আমি আহতদের উদ্ধার কাজে সাহায্য করেছি যার ফুটেজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। আমরা প্রশাসনের নিকট গিয়েছিলাম,তারা বলেছে নিরপরাধ কেউ শাস্তি পাবে না। আমার প্রত্যাশা আমাদের মামলা থেকে নিঃশর্তে মুক্তি দেয়া হোক। অভিযুক্ত শাকিল হোসেন আইমুন বলেন, ঘটনার দিন চবির টিচার্স ক্লাব ভাঙচুরের সময় আমি সহ আরো কয়েকজন মিলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বাধা প্রদান করেছিলাম।আমি কোন ভাঙচুর করিনি। আমি মেন্টাল প্রেসারের মধ্যে রয়েছি। এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক চাপ তো রয়েছেই। অনেক বিরূপ মন্তব্যের সম্মুখীন হচ্ছি। আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত সামনে পরীক্ষা পড়াশোনা করতে পারছি না। অভিযুক্ত নুর মোহাম্মদ মান্না বলেন, আমরা প্রশাসনের নিকট এর প্রতিকার চাইতে গিয়েছিলাম, কারন আমরা প্রকৃত দোষী নই।এই মামলার কারণে আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।পরিবারও আমাকে বিরূপভাবে দেখছে। প্রশাসনের নিকট চাইবো যারা প্রকৃত দোষী তাদের কে সনাক্ত করে আমরা যারা নির্দোষ তাদের খুব শীঘ্রই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। অভিযুক্ত শফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন আমি ভাঙচুর ঠেকানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। ওই দিন স্পটে যারা উপস্থিত ছিল এ বিষয়ে সবাই আমার ভূমিকা দেখেছে। আমরা মানসিকভাবে হ্যাম্পার্ড এবং পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে দুশ্চিন্তা করছে। বিশেষ করে আমরা যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় আছি আমাদের প্রতি একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রশাসন আমাদের বলেছে নিরপরাধ যারা আছে তাদের কোনরূপ শাস্তি বা হয়রানি করা হবে না। আমার প্রত্যাশা এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত হোক এবং প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক,সেই সাথে আমরা যারা নিরপরাধ আছি তাদের দ্রুত মুক্তি দেয়া হোক। অভিযুক্ত অনিরুদ্ধ বিশ্বাস বলেন, আমরা নির্দোষ, এই আইনি হয়রানি আমাদের জীবনটা কে অনিশ্চিত করে দিয়েছে। অতীতে আমি কখনো কোন প্রকার বিশৃঙ্খলার সাথে জড়িত ছিলাম না। আমরা আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে চাই।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড.নুরুল আজিম শিকদার এ ঘটনার সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, এই কাজে যাদের কোন ধরনের সম্পৃক্ততা নেই তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করাটা আমাদের দায়িত্ব। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,উক্ত বিষয় টি কেন্দ্র করে গ্রুপ সমূহের মধ্য উত্তেজনা বিরাজ করছে।বর্তমানে ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতিতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। প্রসঙ্গত, গত ৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম শহর থেকে শাটল ট্রেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পথে চৌধুরী হাট এলাকায় রেললাইনের উপরে হেলে থাকা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে রাত সাড়ে ৮ টার শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছালেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক অবরুদ্ধ করেন। এরি মধ্যে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এ সময় তারা আগুন জ্বালিয়ে প্রশাসনের নিকট শিক্ষার্থী আহতের জবাব ও শাটল ট্রেনের বগি বাড়ানোর দাবি জানান। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা একপর্যায়ে ভিসির বাসভবন, পরিবহন দপ্তরের প্রায় ৬০ টিরও অধিক শিক্ষকবাস সহ প্রাইভেটকার, চবি ক্লাব ও গেস্ট হাউস ভাঙচুর করে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় ৩০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি মামলায় সাতজন করে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও এক হাজার জনকে অভিযুক্ত করা হয়। |